স্মৃতিচারণঃ এক রজনীর
মানুষের জীবনে কত স্মৃতিই না থাকে। সব কিছু কি সবসময় শেয়ার করে সে? কোনটা আনন্দের, কোনটা বেদনার, আবার কোনটা হয় আতংকের। তবে শ্রেণীবিভাগ যেভাবেই করি না কেন, অবশেষে একসময় তা আর শ্রেণীবিভাগ মানেনা। হয়ে যায় যেন অভিজ্ঞতার এক দ্রবণ। সেটা শেষ পর্যন্ত একরকম আনন্দদায়কই হয়।
আজ আমার মনে পড়ছে একটি বেশ আতংকের রজনীর কথা। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ি। হলে উঠেছি তখন বছর খানেক হয়। হলের একটি রুমে সাধারণতঃ দু’টো বেড থাকে। আমার রুমেও তাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন খুব সম্ভবতঃ কোন এক স্বল্পকালীন ছুটি। নতুন রুমমেট। সিট পেয়ে অল্প কিছুদিন হলো এ রুমে উঠেছে। আজ অনেক কষ্ট করে তার ডাকনামটা মনে করতে পেরেছি। বাচ্চু। আমার থেকে জুনিয়র। বাচ্চু চেহারা দেখতে বেশ বলিষ্ঠ মারদাঙ্গা টাইপের হলেও প্রথম কয়েকদিনেই আবিষ্কার করলাম সে অসম্ভব ঠান্ডা, ধীরে হাঁটে, শব্দ হয়না, কথা বলে একদম কম। নিজের ডেস্কে বসে বই খুলে নাক ফুলিয়ে কি যেন ভাবে? বাড়ীর কথা হয়তঃ। দেখে মনে হয় বেশ গরীব ঘরের ছেলে। বাচ্চু ঘর-টানা ছেলে, কাজেই একদিনের জন্যও ভার্সিটি বন্ধ হলে সে শহরগামী ৩.২০ এর শাটল ট্রেন ধরবে। চল-চল বাড়ী চল। কাজেই যে রজনীর কথা বলছি সেদিন রুমে আমি একা। বাচ্চু বাড়ী গেছে।
রাত আড়াইটা কি তিনটা হতে পারে। বেশ রাত করেই আমার ঘুম আসে। ছুটি টুটি থাকলে তো কথাই নেই। কানের কাছে মৃদু বাজতে থাকা টেপ রেকর্ডারটা কখন যে থেমে গেছে জানিনা। ঘুমিয়ে পড়েছি মাত্র। ষষ্ঠ কি সপ্তম ইন্দ্রীয়ের তাড়নায় তা জানিনা, সদ্যপ্রাপ্ত ঘুমখানা একদমই হঠাত্ ভেঙ্গে গেল। কোনো শব্দ নেই, কিচ্ছু নেই। কিন্তু বুঝতে পারলাম রুমের ভিতর কি যেন একটা আছে। বুঝতে পারছি না। শুধু চোখের কোণ দিয়ে বালিশের উপর মাথা রাখা রেখে এবং মাথাটাকে একবিন্দুও না ঘুরিয়ে দেখতে পারলাম বিপরীত দিকের দেয়ালে কি যেন একটা দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছি এটা কি? শরীরের লোমগুলো সব ইতোমধ্যে খাঁড়া হয়ে গেছে। রুমের একটিমাত্র দরজা যা আমার ঠিক পা বরাবর, তা বন্ধই আছে। তাহলে এ ছায়াটা রুমে ঢুকল কিভাবে? গা গির গির করে উঠছিলো। এক অশরীরী প্রেতাত্নার ভয়ে কখন যে আমি মনে মনে কুল হুআয়াল্লা সুরা পড়তে শুরু করেছি জানিনা। তবে মানুষের মস্তিষ্ক দ্রুতই ব্যাখ্যাযোগ্য সমাধান চায়। চিন্তা করে চলেছি, রুমের দরজা বন্ধ, রুমমেট সে-তো বাড়ীতে, এখানে আমি ভিন্ন আর কেউ নেই। অতএব এটির কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারেনা। কিন্তু না, এটি-তো আছে! তাহলে কেম্নে আছে? ঠিক তখুনি সমাধানটা পেলাম। যে মাথাটা এতক্ষণ এতটুকুও নাড়াচ্ছিলাম না, তা সহসাই পুরো পেছন ঘুরিয়ে যা দেখবার দেখে নিলাম। ভাবতেও পারিনি জিনিসটা ঐদিকে থাকবে।
অশরীরী আত্না আর কেউ নয়, সশরীরে চোর মহাশয় দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক আমার মাথার পেছন দিকটার জানালার বাইরে ঝুলন্ত ব্যালকুনিতে। এটি একটি পরিত্যক্ত, ক্লোজড ব্যালকুনি। হল নির্মাণের সময় কেন এটি তৈরী করেছিল জানিনা, তবে এখন সেখানে আছে শুধু জানালা তাও আবার শক্ত রড দিয়ে ঘেরা। ঐ ব্যালকুনিতে কেউ যেতে পারেনা, কোনো প্রবেশ পথই নেই। আর আমি থাকতাম দো-তলায়, ব্যালকুনিতে চোরটা কিভাবে ঊঠেছিলো তা আজও আমার কাছে রহস্য রয়ে গেছে। তবে তার দূর্ভাগ্য যে, হলের পরবর্তী যে বিল্ডিংটি যা কিনা ডাইনিং হল নামে পরিচিত, তার বারান্দায় একটি মৃদু লাইট জ্বালানো ছিল; তারই অতি ক্ষীণ আলো চোরটির শরীরে লেগে আমার রুমের ওয়ালে এই অশরীরী ছায়া উৎপাদন করেছে। সে বড়শীর মত লম্বাকৃতির ছড়ি দিয়ে জানালার গরাদের বাইরে থেকেও আমার রুমের ভিতরের তারে টাঙানো দু’টি জামা (যার একটির পকেটে বিশ-বাইশ টাকার মত ছিল), লুঙ্গি ও আমার নতুন ক্রয় করা জাইঙ্গাটি অপর পাশ হইতে ইতিমধ্যেই হস্তগত করিয়াছে। । এমতবস্থায়, যখনি আমি মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালাম, এবং ভয়ে কিছুক্ষণ আগেও মৃতপ্রায় আমি সশব্দে সজোরে ‘কে, কে ওখানে; চোর-চোর’ বলে চিৎকার করে উঠলাম, তখন আর যায় কোথায়? তবে যায়, আমাকে দ্বিতীয়বার আরেকটি ভয়ংকর উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে দিয়ে তবে যায়। আমি তাকে শুধু ব্যালকুনি থেকে লাফ দিয়ে আমার দৃষ্টিসীমা হতে তিরোহিত হতে দেখি। বুকটা ধক্ করে উঠে। কারণ এ দো-তলা উচ্চতা থেকে নীচে পড়লে যে কেউ অক্কা পেতে পারে, তাছাড়া ওপাশটার নীচের অবস্থা খুবই খারাপ। মানুষজনের কোনো চলাচল নেই, আবর্জনাপূর্ণ, আর সর্বপরি আছে হলের প্রধান ড্রেনটি, যার ভিতর পড়লে চোরটির মারা যাবার সম্ভাবনাই বেশী। একটা সাংঘাতিক অপরাধবোধ জেগে উঠল। হোক না চোর, সামান্য কিছু চুরি করে হয়তঃ বউ পোলাপান নিয়ে একটু সুখী হতে চাইছে। তাই একই সাথে আতংকিত ও উৎকণ্ঠিত হয়ে তাড়তাড়ি জানালের কাছে দাঁড়াই নীচে কি অবস্থা দেখার জন্য। বুকটা সত্যি ধক্ ধক্ করছিলো, যদি দেখি তার রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে নীচে। কি ভয়ংকর অনুভতি হচ্ছিল তখন বুঝানো মুশকিল!
তবে আমার অবাক হবার পালা। একনজর দেখলাম শক্ত-সামর্থ সুঠাম দেহটি আমার উৎকণ্ঠাকে থোড়াই কেয়ার করে কি সাবলীল অ্যাথ্লেটিকদের মত চমৎকার দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে। হাতে কিন্তু তখনও আমার কাপড়-চোপড়গুলো ঠিক ধরে রেখেছে (পরে বাচ্চু হলে ফিরলে জেনেছিলাম তারও দুয়েকটি জামা-কাপড় একই সময় চুরি গিয়েছিল)। ততক্ষণে আমার চিৎকারে আশেপাশের রুমের দু’একজন জেগে উঠেছে। সেদিকে অপেক্ষা না করে দ্রুতই রুমের দরজা খুলে সিঁড়ি বের হয়ে নিচে নেমে গেলাম হলের দারোয়ানের উদ্দেশ্যে। আমি তার নিকট পৌঁছুবার পর সেও খানিকটা চেঁচামেচি করল। আমি তাকে চোরটাকে ধাওয়া করতে বল্লাম। সে একটুখানি এগিয়ে চোরটির প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে আমাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় জানালো-“চোরাইয়া কি আর আছেনা, ইবা এতক্কনত্ জোবরা গেরামে হান্দাই গিইয়েদে”। (অর্থাৎ চোর কি আর আছে নাকি, সে এতক্ষণে জোবরা গ্রামে ঢুকে গিয়েছে)। জোবরা গ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত একটি অনগ্রসর ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম, ঐখান থেকে চোরকে খুঁজে বের করা আর্মির টিম দিয়েও হবেনা। ডঃ ইউনুস এ গ্রামটির কথা মাঝে মাঝে তাঁর বক্তৃতায় বলে থাকেন, ৭৪ এর দূর্ভিক্ষে এ গ্রামের মানুষগুলোর জীবন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, যখন তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করতেন।
জানালার গরাদে চোরটা শুধু তার ঐ বড়শীর ছিপিটা আমার জন্য রেখে গেছে। ঐটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম, যদিও জানি আজ রাতে আর সে আসছে না। যাহোক, রাতে আর ঘুম হলনা। ভাবলাম সকালে ডিম-পরোটা দিয়ে জয়নাল মিয়ার দোকানের নাস্তা খেয়ে তবেই ঘুমাব। তার দোকানে হলের কয়েকজন সাধারণ ছাত্রের কাছ থেকে কিছু তথ্য পেলাম। তারা বলল এ চোরটি আরও কয়েকটি রুমে এভাবে চুরি করেছে। অনেক ছাত্রদের রুমে টাকা-পয়সা, চা’য়ের ফ্লাস্ক, জামা-কাপড় ইত্যাদি চুরি যাচ্ছে। হল প্রশাসন তাকে ধরছে না। আরো জানাল, হল-দারোয়ান এর সাথে এর আঁতাত আছে। আবার হল দারোয়ানের সাথেও একগোষ্ঠী আছে যারা এসবের ভাগ-ভাটোয়ারা পায়। বুঝলাম -আরও আছে যে চোর!