বেশ কিছুদিন তিমুর সাগর পাড়ে যাওয়া হয়না।
বাসা থেকে মিনিট পাঁচেকের পায়ে হাঁটা দূরত্ব। তাই আজ রওয়ানা হলাম। রাস্তার
পাশের কোনো একটি বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছি, এমূহূর্তে বাড়ীর ফেঞ্চের ভেতর থেকে একটা
কুকুর অকস্মাৎ এমন জোরে ঘেউ করে উঠল যে একেবারে হার্টবিট বন্ধ হবার অবস্থা। রক্ষা
শুধু এখানে বাড়ীতে কেহ গার্ড কুকুর রাখলে পুরো বাড়ীর চারপাশেই ফেঞ্চ রাখে। নতুন বা
অপরিচিত কাউকে দেখলেই কুকুরে ডাক ছাড়ে। সে নতুনকেই অমঙ্গল মনে করে। কুকুরের এ
বৈশিষ্ট্য তার মালিকের বাড়ীর নিরাপত্তা রক্ষায় খুব মঙ্গলজনক, সন্দেহ নাই, তবে বহু পথচারীর
জন্য তা ভীষণ অপ্রীতিকর! যাহোক, কুকুরের
ডাক শুনে আমার বছর দুয়েক আগের আরেকটি কুকুরের কথা মনে পড়ে গেল। ঐ কুকুরটিকে কোনোদিন আমি
দেখিনি, তার ডাকও শুনিনি কোনোদিন ; যদিও কোনো একদিন তার ডাক দেওয়ার হয়তঃ খুব প্রয়োজন ছিল! তবে ডাক না দিয়েও সে একটা লোককে চিনিয়ে দিয়েছিল!
বছর দুয়েক আগের কথা। তখন অন্য এক
অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকি। বর্তমান বাসাটি থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে। সকাল ৬
টার মত হবে, কলিং বেল বাজল। এত সকালে কে আবার আসল? দরজা খুলে দেখি দু’জন দাঁড়িয়ে
আছেন। দ্রুত নিজেদের পরিচয় দিলেন পুলিশ ডিপার্টম্যান্টের হোমিসাইড ডিটেকটিভ
বলে।
হোমিসাইড ডিটেকটিভ? ঘুম ভেঙ্গে দরজায়
হোমিসাইড ডিটেকটিভ? কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করলাম? বেশ বিস্মিত হয়েছি। তারা জানাল,
আপনার দু’ বাসা পর গতরাতে যে মার্ডার হয়েছে সে ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু বিষয়ে কথা বলতে পারি
কি?
‘মার্ডার? আমি তো কিছুই জানি না।’
‘জানেন না, গতরাতে ঐ পাশের বাসায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দু’জনই মার্ডার হয়েছেন। ডাবল মার্ডার!
আপনার যদি সম্মতি থাকে, তাহলে আমরা আপনার একটি পুরো স্টেটমেন্ট নিতে পারি।’
ঐ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দু’জনকেই প্রায়শঃ দেখেছি, যদিও
তেমন পরিচয় নেই। বয়স তাদের ৭০ এর কম হবেনা। আমার দু’বাসা পরে থাকে বটে, তবে দ্বিতীয়
বাসাটির পরে মাঝে একটা উঁচু দেওয়াল। একারণে তাদের কমপ্লেক্সটা আসলে বেশ পৃথক। ডিটেকটিভদের
সাথে কথা বলছি আর অ্যাপার্টমেন্টেটির দিকে বারবার চোখ যাচ্ছে। ডিটেকটিভদের একজন
আবার এর মাঝে জানতে চাইলেন, আপনার ঐ দ্বিতীয় প্রতিবেশীটি কি এখন বাসায় আছেন? বললাম, নক
করেই দেখুন না? সে উত্তরে বলল, করেছি, কিন্তু কেহই ভেতর থেকে সাড়া দিচ্ছে না।
ভাবলাম, সাড়া না দিলে তারা ভেতরে নেই। ইনি তাহলে আবার আমাকে একথা জিজ্ঞেস
করছেন কেন? তবে অবশ্য দৃষ্টিটা একটু পরে চলে গিয়েছিল প্রতিবেশীর বাসার
কোনায় দেওয়ালের উপর এয়ার কন্ডিশনটির দিকে। ওটি থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। তার মানে
এয়ারকন চালু আছে। তবে কি তারা ভেতরে নেই? ততক্ষণে আশপাশ দেখে বুঝতে শুরু করেছি, আসলে আশেপাশের সব
ভাড়াটেরাই ভেতরে আছেন, এবং ডিটেকটিভদ্বয়ও
ইতোমধ্যে সবাইকে নক করেছেন, কিন্তু কেউ দরজা খুলছেন না। এখানে কেউ কথা
বলতে না চাইলে, পুলিশ কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া তাকে কথা বলাতে বাধ্য করাতে
পারেন না। কেউ ভলান্টিয়ারিলি বলতে চাইলে সেটা ভিন্নকথা। তবুও আমার কাছে ব্যাপারটা
সাংঘাতিক খারাপ লেগেছে। সবাই দরজা বন্ধ করে নিজেদের ‘কথা না বলার রাইট’ সংরক্ষণ
করছে, অথচ এক প্রতিবেশী বৃদ্ধযুগল গতরাতে খুন হয়ে গেছেন, ব্যাপারটা একদম
স্বার্থপরের মত মনে হচ্ছিল। তাই
ডিটেকটিভটি যখন আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি স্টেটম্যান্ট দিতে রাজী আছেন কিনা, আমি
হ্যাঁ-ই বললাম, তবে এও বললাম, দেখুন, আমি আসলে কিছুই জানি না, আমি বরং এইমাত্র আপনার মুখ
থেকেই শুনছি যে, ঐ বাসায় দু’জন মার্ডার হয়েছেন। আমার স্টেটম্যান্ট আপনার কতটুকু
কাজে লাগবে জানিনা, তবে রাজী আছি।
এবার তাদের ভেতরে আসতে বললাম। একজন ডিটেকটিভই প্রবেশ করল। বাকীজন অন্য কোনো বাসায় নক করতে চলে গেল। তাঁরা বেশ তড়িৎকর্মা, স্মার্ট ও কথাবার্তায় মার্জিত। ডিটেকটিভটি একটি বেশ লম্বা ফরম বের করে আমাকে প্রশ্ন করতে থাকলেন। কতগুলো আমার নিজের সম্পর্কে সাধারণ কিছু ইঙ্কোয়ারি। আমি এক ফাঁকে জানতে চাইলাম, আপনারা কিভাবে খবর পেলেন যে মার্ডার হয়েছে? বললেন, ‘তাদের একটি ছেলে আছে, যিনি বেশ কিছুদিন হল তাঁদের সাথে থাকছেন। সেই পুলিশে ফোন করে জানায়, বাসায় তার মা-বাবার ডেডবডি পড়ে আছে, ছুরি মেরে কেউ তাদের হত্যা করেছে!
‘এখানে, বাসায়।’
‘আপনি কি ঐ সময় কোনোপ্রকার শব্দ শুনতে পাননি?’
‘না’।
‘একটু ভেবে দেখুন, কোনোপ্রকার শব্দ যা
আপনার কানে এসে থাকতে পারে।’
একটু ভাবলাম। তবে একই উত্তরঃ ‘না, আমি তেমন
কোনো শব্দ শুনেছি বলে মনে করি না।’
‘ঐ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার একটি পোষা কুকুর আছে, যা বাসার
ভেতরে তাদের সাথেই থাকে। আপনি গতরাতে কখনও কি ঐ বাসা থেকে কুকুরের কোনো ডাক শুনতে পেয়েছিলেন?’
‘না, তেমন কোনো ডাক শুনেছি বলে মনে হয়না।’
‘আরেকটু স্মরণ করার চেষ্টা করুন, কুকুরের
কোনো ডাক গতরাতে যেকোন সময় আপনার কানে এসেছিল কিনা?’
আগেই বলেছি হত্যাকান্ডের খবরটাই পেয়েছি স্বয়ং
যিনি আমাকে প্রশ্ন করছেন, তাঁরই কাছ থেকে। নিজের কাছে মনে হচ্ছিল এমন কোনো তথ্যতো
তাঁকে দিতে পারছিনা যা তাঁর কাজে লাগবে বলে মনে হয়। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তরেই আমাকে
‘না’ বলতে হচ্ছে। তবুও তাঁর প্রশ্ন করাতে কোনো বিরক্তি নেই।
তাই আমি বেশ কয়েক মূহূর্ত চিন্তা করতে
থাকলাম, এমন কোনো শব্দ কি শুনেছি যা মাথার ভেতর লুকিয়ে আছে, কুকুরের কোন ডাক
গতরাতে? তিনিও আগ্রহের সাথে আমার উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছেন।
তবে আবারও বলতে হল, ‘না’।
ঘরে ঢুকেও যেন স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না।
বারবার মার্ডারের ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কে তাদের খুন করতে পারে? কয়েকমাস
আগে আমার বাসায় ব্রেক-ইন হয়েছিল। এগুলো সাধারণতঃ তেমন হয়না। কে যেন ঘরে ঢুকে
আমার ল্যাপটপ, একটা এক্সট্রা হার্ডড্রাইভ, ওয়ালেট ও পাসপোর্টসহ বেশ কিছু জিনিস
চুরি করে নিয়েছিল। দরজাটা খোলাই পেয়েছিলাম। তখন পুলিশে খবর দিলে তারা ডায়েরী
করেছিল।এরপর অবশ্য চোর ধরতে পারেনি। এ ব্যাপারটার কথাও আজ যখন ডিটেকটিভ সাহেব
প্রশ্ন করছিলেন, তাকেও কথা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য করেছি। ডারউইন শহরকে সাধারণতঃ অষ্ট্রেলিয়ার
আদিবাসীদের অলিখিত রাজধানী বলা হয়। আদিবাসীদের মধ্যে কারো কারো এসব টুকিটাকি চুরির
অভ্যাস আছে বলে নানা পরিসংখ্যানে উল্লেখ। তাই ভাবছিলাম ঐ বৃদ্ধদের বাসায় হয়তঃ ঐ
টাইপের কোনো ছিঁচকে চোর ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাকে চিনে ফেলে অথবা ধরে ফেলে, তখন হয়তঃ সে
তাদের খুন করে পালিয়ে যায়। কারণ চুরিতে ধরা খেলেও আইনানুযায়ী তাকে বেশ কয়েক বছর
জেল খাটতে হতে পারে। এটাই ছিল আমার আমার সলিউশান। তাছাড়া কার এমন কি মোটিভ থাকতে পারে এধরণের বয়স্ক দম্পতীদের
খুন করার?
“ঐ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ছেলে পুলিশ ও
অ্যাম্বুলেন্সকে ভোরে টেলিফোন করে জানায় যে, তার মাতাপিতাকে কে বা কারা হত্যা
করে অ্যাপার্টমেন্টে ফেলে রেখে গেছে। আমরা তাদের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে মৃতদেহগুলো
পাই, তবে দরজা বা জানালা ভেঙ্গে বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করেছে বলে তেমন কোনো চিহ্ন পাইনা।
বাড়ীর আশেপাশে এবং পিছনের পার্কে হত্যাকারীর মার্ডার-ওয়েপনটি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও
পেতে ব্যর্থ হই। আমি আশেপাশের কয়েকজন প্রতিবেশীর সাথে কথা বলতে সমর্থ হই, যাদের
প্রত্যেকই জানান যে, তারা গতরাতে ঐ বাসা থেকে কোনপ্রকার সন্দেহজনক শব্দ বা ধ্বস্তাধস্তির
আভাষ পাননি। কোনো প্রতিবেশীই বৃদ্ধদ্বয়ের পোষা কুকুরটিকে ডেকে উঠতে শুনেননি। এমতাবস্থায়, আমার
দৃঢ় সন্দেহ হয় যে, হত্যাকারী কুকুরটির খুবই পরিচিত ছিল, যে কারণে তার আগমণে সে
কোনপ্রকার শব্দ করেনি। এসব আমাকে এটাই ইঙ্গিত করছিল যে, খুনীর অনুপ্রবেশ বাইরে থেকে
হয়নি। কারণ প্রতিবেশী, পার্কের মাঠ ও আশেপাশের প্রতিটি জায়গায় আমার অনুসন্ধান করে কিছুই পায়নি,
ফলাফল জিরো। এটিই বরং আমার কেসটিকে সঠিক দিকে দেখতে সাহায্য করে। আমি তখন দিনে দ্বিতীয়বারের
মত ঐ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ৪০ বছর বয়সের ছেলের সাথে আবারও কথা বলার সিদ্ধান্ত নিই, যে
কিনা প্রথম তার মাতাপিতার খুন হওয়ার খবরটি আমাদের ফোন করে জানায়। তাকে আমি তখন পাই
শহরের একটি বারে পানরত অবস্থায়। আমি তাকে জিজ্জাসাবাদ করার জন্যই থানায় নিয়ে যাই, যদিও অনেক
রিপোর্টার আমি তাকে গ্রেফতার করেছি বলে তখন একটি ছোট্ট খবর ছাড়ে। কিন্তু তখনো আমি
তাকে গ্রেফতার করিনি। জিজ্ঞাসাবাদের প্রশ্নজালে সে সামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তর দিতে
ব্যর্থ হয়। এরপর বেশী বেগ পেতে হয়নি। এক পর্যায়ে সে স্বীকার করে যে, সে-ই তার মাতাপিতাকে খুন করেছে একটি
ছুরি দ্বারা। তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আমরা ঐ মার্ডার ওয়েপনটিকেও উদ্ধার করতে সমর্থ
হই। খুনীর বেশ কিছু মানসিক সমস্যা আছে, তার কথাবার্তায় মাতাপিতার সাথে তার বেশকিছু
তিক্ত সম্পর্কের কথা বেরিয়ে এসেছে। এরপরই আমি তাকে গ্রেফতার করি।’